ধান চাষের সকল পদ্ধতি, আউশ ধান, আগাছা দমন পদ্ধতি, সার প্রয়োগ, সেচওপানির ব্যবস্থা, অনিষ্টকারী পোকামাকড়, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, কাটা, মাড়াই ও বীজ সংরক্ষণ নিয়ে আমরা আজকে বিস্তারিত জানবো। বাংলাদেশ হচ্ছে কৃষি প্রধান দেশ। ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। ধান উৎপাদনে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ধান বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।।বাংলাদেশ পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশের ধানের জাতগুলির আদিরূপ, যা এখন বিপন্ন ।বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের পরিমাণ (কোটি টন)। বাংলাদেশে ধানচাষের আওতায় রয়েছে মোট শস্যক্ষেত এলাকার ৭২% জমি। সারাবছরই এখানে ধানচাষ চলে, ফলে গ্রামাঞ্চলের কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ ধানচাষ চাষনির্ভর। বাংলাদেশে ধান এর চাহিদা বেশি থাকার কারনে ধান চাষ বেশি হয়।
আউশ ধান কী ভাবে চাষ করবেন ?
আউশ ধানের চাষাবাদ বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশে ধান চাষের পদ্ধতি চৈত্রের মাসের শুরু থেকে বৈশাখের মাসের মধ্যে বৃষ্টিপাতের সাথে তাল মিলিয়ে আউশ ধানের চাষাবাদ জমি তৈরি ও বীজ বপনের কাজ শুরু করতে হয়। আউশ ধানের আরেক টি নাম রয়েছে আষাঢ়ী ধান। সাধারণত বর্ষাকালের এই ধান চাষ করা হয় বলে এই ধান কে আষাঢ়ী ধান বলে। আউশ ধান সমতল, জলাভূমি ছাড়াও পাহাড়ী অঞ্চলেও চাষ করা হয়। আউশ ধানের ভাল ফলন পেতে হলে ভালভাবে জমি তৈরি করতে হয়।
ধান চাষ জমিতে সার প্রয়োগ
ধান গাছের বাড়তির সময় বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন মাত্রায় নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়।ধান চাষের জমি তৈরির শেষের সময় প্রতি শতাংশ জমিতে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া,৩০০ গ্রাম এমপি ও ২০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বৃষ্টিবহুল বোনা আউশ এলাকায় ইউরিয়া দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভাল প্রয়োগ করা ভাল। প্রথম দিকের কুশি গজানোর সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে তা থেকে গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন গ্রহণ করে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার যেমন টিএসপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট মাত্রানুযায়ী জমি তৈরীর শেষ পর্যায়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে বেলে মাটিতে পটাশ সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
জমিতে ধান চাষের আগাছা দমনের পদ্বতি কি ?
সেজেস – চেঁচড়া, হলদে মুথা, বড় চুচা, জয়নাঘাস – দূর্বা, ক্ষুদে শ্যামা, বড় শ্যামা চওড়া পাতা – শুষনি শাক, ঝিল মরিচ, চাঁদ মালা, পানি কচু, পানি লং, পানি ডগা ইত্যাদি হলেো আগাছা। ধান চাষের পদ্ধতি আগাছা খাদ্যে ভাগ বসায়আলো, বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে পোকা মাকড় ও রোগ বালাই এর আশ্রয়স্থল ফলন কমিয়ে দেয় উৎপাদন খরচ বাড়ায়। রিফিট + লগরান একসাথে ব্যবহার করুন। মাত্রাঃ প্রতি একর রিফিট ৪০০ মিঃলিঃ + লগরান ৩ গ্রাম।জমিতে আগাছা দমনের ব্যবহারবিধি হলো চারা রোপনের ৩-৭ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করতে হবেইউরিয়া সারের (৪-৫ কেজি) সাথে মিশিয়ে সমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে১-২ ইঞ্চি দাঁড়ানো পানি থাকতে হবেপানি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেচ দেউয়া যাবে না
ধান চাষের সেচওপানির ব্যবস্থা
বাংলাদেশে ফসল উৎপাদনের জন্য সেচ অপরিহার্য।ধান ও ফল-ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন পরিমিত সেচ ব্যবস্থা প্রয়োজন তেমনি জমির উর্বরতা বজায় রাখতেও পরিমিত সেচ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। সেচের মাধ্যমে গভীর নলকূপ দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন অথবা খাল, বিল, নদীনালার পানি উত্তোলন করা হয়।এজন্য জ্বালানি হিসেবে ডিজেল, গ্যাস বা বিদ্যুৎ প্রয়োজন।বেশি পানি উঠাতে গেলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎতেরও ব্যাপক অপচয় ঘটে। বাংলাদেশে আউশ, আমন, ইরি ও বোরো ধান আবাদের ক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।
বিশেষ করে বোরো ধান আবাদেই এখন দেশের খাদ্য চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করে। ফসল আবাদের সময় সেচের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎপ্রয়োজন হয়। এ সময় বিভিন্ন এাকায় বিদ্যুৎতের ঘাটতি তৈরি হয়। বোরো আবাদে সেচের জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ করতে হয়। বোরো মৌসুমে সেচের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এজন্য বোরোর আবাদ এলাকায় আর না বাড়িয়ে আউশ এবং বৃষ্টিনির্ভর আমন ধানের আবাদ এলাকা বাড়ানোর জন্য সরকারি প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার। বোরো চাষে সেচ কাজে পানির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়- যা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি অধিক পরিমাণে উত্তোলন করা হয়।
ধান চাষের জমিতে অনিষ্টকারী পোকামাকড়
নিবিড় চাষা বাধের কারণে পোকা মাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। ব্রি এ পর্যন্ত ধানের ২৬৬ টি প্রজাতির ক্ষতিকর পোকা শনাক্ত করেছে। এদের মধ্যে ২০-৩৩ টি প্রজাতিকে ধানের প্রধান ক্ষতিকর পোকা হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলো হল- মাজরা পোকা, নলি মাছি, পাতা মাছি, পামরী পোকা, চুংগী পোকা, পাতা , ঘাস ফড়িং, সবুজ শুঁড় লেদা পোকা, ঘোড়া পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, আঁকাবাঁকা পাতা ফড়িংছাতরা পোকা, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, উরচুংগা ইত্যাদি।
ধান চাষের পদ্ধতি মাজরা পোকার আক্রমণ ফুল ফোঁটার আগে হলে মরা ডিগ এবং ফুল ফোঁটার পরে হলে সাদা শিষ বের হয়।ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলুন।আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা (মথ) সংগ্রহ করে দমন করুন। ধান ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির সাহায্য নিন।পরজীবী (বন্ধু) পোকা মাজরা পোকার ডিম নষ্ট করে ফেলে । সুতরাং যথাসম্ভব কীটনাশক প্রয়োগ বিলম্বিত করুন।জমিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ মরা ডিগ অথবা শতকরা ৫ ভাগ সাদা শিষ দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করুন। আমন ধান কাটার পর চাষ দিয়ে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলুন।
ধানের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
বিভিন্ন ধরনের রোগ-বালাই ধানের ক্ষতি করে এবং ফলন কমিয়ে দেয়। এ জন্য রোগ শনাক্ত করে তার জন্য ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। বাংলাদেশে মোট ৩২টি শনাক্তকৃত রোগের মধ্যে ১০টি প্রধান।পর্যায়ক্রমে ধানের বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বন্ধ বা নিয়ন্ত্রনের জন্য ১০টি প্রধান রোগ শনাক্ত করোন।টুংরো ভাইরাসজনিত রোগ। সবুজ পাতাফড়িং এ রোগের বাহক। চারা অবস্থা থেকে গাছে ফুল ফোটা পর্যন্ত সময়ে এ রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের ক্ষেতে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গাছের পাতা হলুদ বা কমলা রঙ ধারন করে।
অনেক ক্ষেত্রে ধানে সালফার বা নাইট্রোজেন সারের ঘাটতিজনিত কারণে এবং ঠান্ডার প্রকোপে এরূপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্ত জমির ধান বিক্ষিপ্তভাবে না হয়ে সমভাবে হলুদাভ বা কমলা রঙ ধারন করে। গাছের বাড়-বাড়তি ও কুশি কমে যায় ফলে আক্রান্ত গাছ সুস্থ গাছের তুলনায় খাটো হয়।এই রকম ধরনের রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। আগাম বীজতলায় বিশেষ করে আমন ধান কাটার সময়, বোরোর বীজতলায় সবুজ পাতাফড়িং দেখা গেলে হাতজাল বা কীটনাশক প্রয়োগ করে দমনের ব্যবস্থা নিন। নিবিড় ধান চাষ এলাকায় ভলান্টিয়ার রাইস/রেটুন ধান তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন অথবা জমিতে চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিন।আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলুন।সবুজ পাতাফড়িং দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
আরো পড়ুনঃ সাইবার অপরাধ ও সচেতনতা কি | নিরাপত্তা আইন ও করণীয়
ধান কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শীষের ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে।অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শিষ ভেঙ্গে যায়, শিষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির অক্রমণ হতে পারে। শিষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে।তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবেশীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ এবং শীষের নিচের অংশে শতকরা ২০ ভাগ ধানের চাল আংশিক শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। ফসল কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা উচিত।তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করা যায়।
ধান মাড়াই করার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিন।এর পর কাচা খলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নিন।এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে এবং এমতাবস্থায় গুদামজাত ও আর্দ্রতা-রোধক গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে।অর বাদলা দিনে কোনো উপায় না থাকলে ধান মাড়াই করে সাধ্যমত ঝেড়ে বস্তায় ভরে যে কোনো জলাশয়ে ২/৩ হাত গভীর পানিতে খুঁটির সাথে বেঁধে ডুবিয়ে রাখুন যেন ধানের বস্তা ডুবন্ত অবস্থায় মাটির সংস্পর্শে না আসে। এভাবে ১০ দিন পর্যন্ত পানির নিচে রাখলেও ধান নষ্ট হয় না। ধান পানিতে ডুবানোর ফলে কিছুটা গন্ধ হলেও সিদ্ধ করার পর ভালভাবে শুকানো হলে আর গন্ধ থাকে না।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ধান চাষের পদ্ধতি ভাল ফলন পেতে হলে ভাল বীজের প্রয়োজন। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন যে জমির ধান ভালভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ ও শুঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে।বীজকে পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অবস্থায় পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে কৌশল অনুসরণ করা হয় তাকে সংরক্ষণ কৌশল বলে। সংরক্ষিত বীজের বড় শত্রু হল আদ্রর্তা ও তাপমাত্রা।
পদ্ধতি সঠিক না হলে বীজ একধরনের ছত্রাক ও পোকার আক্রমণ হয় যা বীজের গজানো ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ও বীজ খেয়ে নষ্ট করে ফেলে।ফসল উৎপাদনে বীজ যত মানসম্মত হয় ফলন ততবেশি হয়, তত ভালো হয়। ভালো মানসম্মত বীজ যতটুকু না উৎপাদন কৌশলের ওপর নির্ভর করে তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে যথাযথ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণের ওপরশেষ কিছু কৌশল আর পদ্ধতি অবলম্বন করলে সাধারণ পদ্ধতি অসাধারণ পদ্ধতিতে পরিণত হয়। বীজ মাটির পাত্রে, বোতলে, পটে, টিনে, ড্রামে, প্লাস্টিকের ড্রামে, বস্তায় সংরক্ষণ করা হয়। তবে বীজ পাত্রের পছন্দ নির্ভর করে বীজের পরিমাণ, জাতের ওপর। যেমন- শাকসবজির বীজ হলে বোতলে/পটে, ডাল তেল বীজের জন্য পট বা টিনে আর দানাদার বীজ হলে ড্রাম, মাটির পাত্র, পলিথিনের বস্তায় রাখা যায়।
আশা করছি, আপনারা বাংলাদেশের ধান চাষের সকল পদ্ধতি । যা যা প্রয়োজন সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে পেরেছেন। ফাস্টবিডিইনফো সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।